আর্থিক দুরাবস্থার কারনে ঢাকা থেকে লাশ আনতে পারেননি হতদরিদ্র এক চা শ্রমিক পিতা

0
78

কে এস এম আরিফুল ইসলাম: মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গল উপজেলার মির্জাপুর চা বাগানের স্থায়ী বাসিন্দা সুজন কালিন্দী (২৫)। যার প্রতিদিনের মজুরী ১০২ টাকা। কিছুকাল আগেই সুজন বিয়ে করেছেন রয়েছে একটি শিশু সন্তানও। তার ঘরে মা নেই, বৃদ্ধ বাবাও জীবন সায়াহ্নে। করোনাকালে স্ত্রীও ছিলেন বাপের বাড়িতে। সংসারে একটু সচ্ছলতার জন্য নিজে প্রায় তিন মাস আগে চাকুরীর খোঁজে ডাকছড়া চা বাগানের এক স্বজনের মাধ্যমে চাকুরী নিয়েছিলেন ঢাকার সাভারের বিরুলিয়ার আলফা ড্রিংকিং ওয়াটার ফ্যাক্টরীতে। রিকশাভ্যানে করে ভোর থেকে সন্ধ্যে পর্যন্ত ক্রেতাদের নিকট সরবরাহ করতেন পানীয় জল। আর বসবাস করতেন রাজধানীর পল্লবী থানাধীন মিরপুর-১০ নাম্বার সেকশনের এ ব্লকের ৭ নাম্বার রোডের ৫ নাম্বার মেসবাড়িতে। বাড়ির মালিকের নাম আব্দুল গফুর।

রবিবার (৬ জুলাই) দিবাগত রাত দেড়টার দিকে সে করোনা উপসর্গ নিয়ে মারা যায়। অনুসন্ধানে সুত্রে আমাদের জানায় যে, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের একটি দল হিন্দু ধর্মের রীতি অনুযায়ী তাকে সৎকার করে। করোনার এই অভিঘাতের সময়ে সুজনের শরীরটা ভালো যাচ্ছিলো না। কিছুদিন অসুস্থতা বোধ করার পর মালিক সাইফুল ইসলামের সহযোগীতায় ডাক্তার দেখিয়ে সুস্থ্য হয়ে গত শুক্রবার কাজে যোগ দেয়। কিন্তু এক দিন যেতে না যেতেই আবারো জ্বর ও সর্দিতে ভুগতে থাকে। এ অবস্থায় গেলো রোববার তার অবস্থা শোচনীয় পর্যায়ে চলে যায়, এক পর্যায়ে তাকে আ্যম্বুলেন্সযোগে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে পাঠানো হলেও চিকিৎসার আর সুযোগ হয়ে উঠেনি। পথিমধ্যেই রবিবার রাতে দেড়টার দিকে মৃত্যুবরণ করে সে। পরে অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে তার পিতার আসার অপেক্ষায় থেকে অবশেষে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে সোমবার রাত আটটার দিকে সৎকার করা হয়। আর সৎকারের পর এসে পৌঁছান সুজনের পিতা। শেষ দেখাটি আর দেখতে পারেননি। এ ভাষ্য ঐ কোম্পানীতে চাকরী করা সুজনের বিপনন বিভাগের সহকর্মী সহিদুল ইসলামের।

এছাড়া এ বিষয়ে বক্তব্য নেওয়ার জন্য ঐ কোম্পানীর মালিক সাইফুল ইসলামের মুঠোফোন নাম্বারে বারংবার যোগাযোগ করা হলেও তিনি কল ধরেননি, একপর্যায়ে সেল ফোনটি বন্ধ পাওয়া যায়।
এ ব্যাপারে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি আব্দুস সালাম মুঠেফোনে চায়ের দেশকে জানান, আলফা ড্রিঙ্কিং ওয়াটারের শ্রমিক সুজন ১০/১২ দিন আগে থেকেই অসুস্থ ছিলো, করোনার উপসর্গ ছিলো।

শ্বাসকষ্ট দেখা দিলে আ্যাম্বুলেন্স করে জাতীয় হার্ট ফাউন্ডেশন নেওয়ার পথে মারা যায়। ‘ব্রড ডেড’ হিসেবে একটি সনদ প্রদান করেছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ। মালিকের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, ‘ওর পিতা নাকি লাশ নেবে না এমন বলেছেন, সম্ভবত বাগানের ব্যবস্থাপকের মোবাইল ফোনে ওনারা যোগাযোগ করেন।’ আমাদের নিকট সকাল দশটার দিকে আ্যম্বুলেন্স চালক পরিচয় দিয়ে বেওয়ারিশ লাশ দাফন করা হয় কিনা বলে সাহায্য চায় বিপাকে পড়া আ্যম্বুলেন্স চালক। কিন্তু আমরা তাকে বলি, আ্যাম্বুলেন্সে আসা লাশ তো বেওয়ারিশ হয় না। আমরা তার অবস্থান জানতে চাইলে, সে জানায় পল্লবী থানায় রয়েছে।

হসপিটালে নামের তথ্য ভুল দেওয়ার কারনে নাম লিখা হয় মো. সুজন! হাসপাতালে যাওয়ার পথে মালিকপক্ষের আরও একজন ছিলেন বলে জানান তিনি। নামবিভ্রাটের কারনে এ লাশকে কিভাবে দাহ করা হবে? কেউ এগিয়ে আসেনি। মানবিক কারনে আমরা পাশে থাকি।পরে স্থানীয় কাউন্সিলর ও সাংবাদিকের সহযোগীতায় পুনরায় হাসপাতাল থেকে নাম সংশোধন করিয়ে প্রকৃত নামে দ্বি-নকল মৃত্যুসনদ পেয়ে পুলিশ ও ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের সংশ্লিষ্ট কাউন্সিলরের অনুমতি এবং মালিক সাইফুল ইসলামের অনুরোধে আমরা সোমবার রাত আটটার দিকে সকল প্রকার স্বাস্থ্যবিধি ও হিন্দু ধর্মীয় রীতি মেনে দাহকার্য সম্পন্ন করি। আমাদের পুরোহিত হিসেবে অজয় পাল’র নেতৃত্বে ৫ জনের একটি টিম এ সংকার কাজটি রাজধানীর পোস্তগোলা শ্মশানঘাটে সম্পন্ন করে। তিনি নিশ্চিত করে জানান, অনেকক্ষণ অপেক্ষায় থেকে একপর্যায়ে লাশের গন্ধ এলাকায় ছড়াতে থাকলে তারা কাউন্সিলরের ও মালিকের অনুরোধে চিতায় লাশ উঠান।

ততক্ষণেও ঢাকায় এসে পৌঁছাননি সুজনের পিতা, দেখতে পারেননি শেষবারের মতো ছেলের মুখটি। তবে, সুজনের মৃত্যু সংবাদ শুনে কালবিলম্ব না করে পিতা বকুল কালিন্দি ঢাকায় ছেলেকে দেখতে যান বলে জানান মির্জাপুর চা বাগানের ব্যবস্থাপক মো. সাইদুজ্জামান। সাথে এও যোগ করেন, আর্থিক দুরাবস্থার কারনে করোনার এই সময়ে লাশ ঢাকা থেকে আনতে পারেননি তিনি। অন্তত ১০ হাজার টাকা যাতায়াত খরচ যোগানোর মতো সাধ্য তার ছিলো না।

মির্জাপুর চা বাগানের কর্মচারী গৌতম বলেন, ‘ছেলের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে বকুল ও তার অন্য দুজন আত্মীয় ঢাকায় যান, সেখানে সংকার করা হয় বলে আমরা জেনেছি। বকুল কালিন্দি আজ (মঙ্গলবার) ভোরে ফিরে এসেছেন। নিজের ঘরে কোয়ারেন্টিনে রয়েছেন এবং চা বাগান কর্তৃপক্ষ কোয়ারেন্টিনকালীন সময় পর্যন্ত তাকে বিনাশ্রমে মজুরী প্রদান করবে।’ মৃত সুজন কালিন্দীর পিতা বকুল কালিন্দি কোয়ারেন্টিনে থাকায় তার সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি।

তবে স্থানীয় ইউপি সদস্য শাহিনুর ইসলাম চায়ের দেশকে জানান, ‌’সুজন হাঁপানি ও শ্বাসকষ্টের দোষ ছিলো এবং ঢাকায় মারা যায়। ছেলের লাশ আনার জন্য কেউ তার পিতাকে আর্থিক সহায়তা করেনি, চা বাগানের ডেপুটি ম্যানেজারের সাথেই মূলত কথা হয়েছে ঢাকা থেকে। আসলে কেউ তাকে সহযোগীতা করেনি লাশ ঢাকা থেকে আনতে। তাদের নিজস্ব সমাজও সে হিসেবে এগিয়ে আসেনি। তবে সুজনের পিতা ঢাকায় গিয়ে ছেলের সংকার কার্যে অংশগ্রহণ করেছেন বলে আমরা জেনেছি।’

পল্লবী থানার ওসি নজরুল ইসলাম ঘটনার সত্যতা স্বীকার করে বলেন, সুজনের মৃত্যুর খবর পাওয়ার পর পুলিশের একটি টিম তার ভাড়া মেসে গিয়ে সন্ধান চালায়। তার পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পর স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলরের কাছে বিষয়টি জানানো হয়। এ সম্পর্কে গতকাল পর্যন্ত (সোমবার) জানি যে, ছেলেটি মারা গেছে, তার অভিভাবক আসবেন। তবে, আলফা ড্রিকিংয়ের মালিক সাইফুল ইসলাম (যেখানে সে কাজ করে) প্রথমে বলছেন, ছেলের অভিভাবক আসবে না। আমাদের কাছে ঐ মৃত ছেলের মালিকপক্ষ বেওয়ারিশ সনদ চেয়েছিলো কিন্তু আমরা তা দিতে অপারগতা প্রকাশ করি যেহেতু তার পিতা ও স্বজনরা রয়েছেন এই মর্মে আমরা অবগত।