বাংলাদেশের হারের ৫ কারণ

ওয়ানডে ক্রিকেটের সব মানদণ্ডে বাংলাদেশের চেয়ে পাকিস্তানে এগিয়ে থাকলেও, পাকিস্তানে যে এত অনায়াসে জিতে যাবে সেটি অনেকেই ভাবেননি। বাংলাদেশের ব্যাটিং লাইন-আপ যেভাবে হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়েছে সেটি দলের ব্যাটিং সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে। পাকিস্তানের ক্ষুরধার বোলিংয়ের সামনে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সাজঘরে আসা-যাওয়ায় ব্যস্ত ছিলেন।

এশিয়া কাপের সুপার ফোর পর্বের প্রথম ম্যাচেই পাকিস্তানের কাছে বড় ব্যবধানে হেরেছে বাংলাদেশ। বুধবার লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে আগে ব্যাট করে মাত্র ১৯৩ রানে গুটিয়ে যায় তারা। জবাবে ৩ উইকেট হারিয়ে ৩৯ ওভার ৩ বলেই লক্ষ্যে পৌঁছায় স্বাগতিক পাকিস্তান।

এ ম্যাচে আবারো ব্যাটিং ব্যর্থতা বড় হয়ে দেখা দিয়েছে বাংলাদেশ দলের সামনে। তবে সর্বোপরি টিম কম্বিনেশন নিয়েই উঠেছে প্রশ্ন।

মিরাজের ওপেনিং নিয়ে প্রশ্ন
গত ম্যাচে আফগানিস্তানের সাথে ওপেনিংয়ে নেমে সেঞ্চুরির দেখা পান মেহেদী হাসান মিরাজ। পাকিস্তানের সাথে ম্যাচেও নাঈম শেখের সাথে ব্যাটিংয়ের শুরুটা করেন তিনি। কিন্তু এদিন তার স্থায়িত্ব হয় মাত্র এক বল। দ্বিতীয় ওভারে আক্রমণে আসা নাসিম শাহর করা প্রথম বলেই ক্যাচ তুলে দেন তিনি। তাই প্রশ্ন উঠছে মূলত নিচের দিকে ব্যাট করা মিরাজকে এদিনও মেকশিফট ওপেনার হিসেবে নামানোর সিদ্ধান্ত কতটা সঠিক ছিল?

জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার ও বিশ্লেষক সানোয়ার হোসেন বলেন, ‘আমাদের সাত নম্বর জায়গাতে মিরাজ কিন্তু প্রুভেন পারফরমার। গত ম্যাচে হয়তে পরিস্থিতি ভিন্ন ছিল। কিন্তু আজকে মিরাজকে সাত নাম্বারে আনলে আমার দৃষ্টিতে ভালো হতো।’

তিনি মনে করেন ওপেনিংয়ে স্পেশালিস্ট ব্যাটসম্যানদেরই ওপরই ভরসা রাখতে হবে, কারণ বিশ্বের সেরা সব পেস বোলারদের মুখোমুখি হতে হয় এখানে।

পেস বোলিংয়ের সামনে অসহায়
এ ম্যাচের আগে থেকেই আলোচনায় ছিল পাকিস্তানের পেস অ্যাটাক। এই মুহূর্তে বিশ্বের অন্যতম সেরা শাহিন শাহ-হারিস রউফ আর নাসিম শাহদের নিয়ে গড়া পাকিস্তানের ফাস্ট বোলিং ইউনিট। এশিয়া কাপেরও সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীর তালিকার শীর্ষে এই তিনজনই। তাই তাদের কিভাবে সামলায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা সেটাই ছিল দেখার।

কিন্তু সেখানে পুরোপুরি ব্যর্থ বাংলাদেশ দল। এ তিনজনের কাছেই ৮ উইকেট হারিয়েছে বাংলাদেশ। যার চারটিই ছিল প্রথম দশ ওভারের মধ্যে ৪৭ রানের মাথায়।

নাঈম সেট হয়েও আউট ২০ রান করে। ইনজুরিতে পড়া শান্তর জায়গায় আসরে নিজের প্রথম ম্যাচ খেলতে নেমে লিটন দাস আউট ১৩ রান করে। তৌহিদ হৃদয়ের ব্যাট থেকে আসে মাত্র ২ রান।

আর এখানেই বাংলাদেশ দল ম্যাচটি হেরে গিয়েছে বলে মনে করেন অধিনায়ক সাকিব আল হাসান। বলেন, ‘আমরা আসলে শুরুতেই হেরে গিয়েছি, তারা দারুণ বল করেছে এবং আমরা খুবই বাজে শট খেলেছি। এরকম উইকেট প্রথম ১০ ওভারেই আপনি চার উইকেট হারাতে পারেন না।’

জাতীয় দলের সাবেক ক্রিকেটার সানোয়ার হোসেন বিবিসি বাংলাকে বলেন, পাকিস্তানের পেস বোলিংয়ের সামনে বাংলাদেশের অসহায়ত্ব চোখে পড়েছে।

‘রিয়েল কোয়ালিটি পেস বোলিংয়ের সাথে আমাদের ব্যাটসম্যানদের ত্রুটি চোখে পড়ে। নাঈম শেখ বলেন বা তৌহিদ হৃদয়, আরেকটু ইমপ্রুভ করার জায়গা আছে। কিছু টেকনিক্যাল দিকে কাজ করতে হবে,’ বলেন সানোয়ার হোসেন।

ধৈর্যের অভাব
বাংলাদেশ পাকিস্তানের সাথে এদিন শেষ ৪ উইকেট হারিয়েছে মাত্র ৩ রান তুলতেই। ফিফটি করা দুই ব্যাটসম্যান সাকিব আর মুশফিক আউট হওয়ার পর আর কেউ দাঁড়াতেই পারেননি। ফলে ১১ ওভার ২ বল আগেই অলআউট হয়ে যায় বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা।

‘সাকিব আউট হওয়ার পর যখন আমাদের সাত-আট নম্বর ব্যাটসম্যান নামে, তখনো কিন্তু অনেক সময় হাতে, তাড়াহুড়ো না করে ধীরে সুস্থে সেটেল হতে পারতে তারা। ১৫-১৬ ওভার হাতে ছিল, একটা ভালো স্কোর করার সুযোগ ছিল। কিন্তু ওই বুদ্ধিমত্তা খেলোয়াড়দের মধ্যে দেখিনি,’ বাংলাদেশের লোয়ার মিডল অর্ডার নিয়ে নিজের আক্ষেপ জানান সানোয়ার হোসেন।

তিনি মনে করেন এক্ষেত্রে তরুণদের আরো দায়িত্ব নিয়ে খেলতে হবে।

বলেন, ‘টিম কম্বিনেশন দেখেন, দলে এতগুলো ব্যাটসম্যান। কিন্তু অ্যাপ্রোচ ঠিক হয়নি। শুধু সিনিয়র না, তরুণদের অনেক বেশি দায়িত্ব নিয়ে পরিস্থিতি অনুযায়ী খেলতে হবে।’

দুই অভিজ্ঞ সাকিব-মুশফিক ছাড়া এ ম্যাচে আর কোনো জুটিই গড়তে পারেনি বাংলাদেশ। তাই তো ঘুরে ফিরে আবারো আলোচনায় বাংলাদেশ দলের সাত ও আট নম্বর পজিশনের ক্রিকেটার। এশিয়া কাপে এই পজিশনে সুযোগ পেয়েছেন আফিফ হোসেন ও শামীম পাটোয়ারি। কিন্তু এখনো বাংলাদেশ দল সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে পায়নি বলে মন্তব্য দলের সহকারী কোচ নিক পোথাসের।

তিনি বলেন, ‘আমরা আসলে দলের সঠিক কম্বিনেশন খুঁজে পেতে কাজ করছি। আমাদের দলটা নানা পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, এখন ধারাবাহিক হয়ে ওঠাই আমাদের লক্ষ্য।’

তবে এরই মধ্যে সোশ্যাল মিডিয়ায় নতুন করে উঠেছে মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ প্রসঙ্গ। তাকে বাদ দেয়ার প্রবল সমালোচনা করছেন কেউ কেউ।

‘এ টুর্নামেন্টে শামীম-আফিফ আরো সুযোগ পাবে। কিন্তু যদি পারফর্ম করতে না পারে তাহলে রিয়াদের কথা চিন্তা করাই যায়, সে কিন্তু প্রুভেন পারফরমার, বড় বড় টুর্নামেন্টে পারফর্ম করার সামর্থ্য আছে,’ বলছিলেন সানোয়ার।

তবে ভিন্ন আলোচনাও আছে, অনেকেই মনে করেন রিয়াদ ফিরলেই যে সঙ্কট কাটবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই।

বাড়তি বোলার সঙ্কট
বাংলাদেশের বোলিং সাম্প্রতিক সময়ে অনেক বেশি পেস বোলার নির্ভর। দলে সাধারণত তিন পেসারের সাথে দুই স্পিনার নিয়ে খেলছে বাংলাদেশ। ফলে বোলিং অপশন থাকছে অনেক কম। ৫০ ওভারের ম্যাচে মূলত পাচঁজন প্রধান বোলারের ওপরই নির্ভর থাকছে দল। ফলে একজন জেনুইন ষষ্ঠ বোলারের অভাব প্রায়ই বোধ করছে বাংলাদেশ।

এবারের এশিয়া কাপে শুধু শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচে ষষ্ঠ বোলার হিসেবে শেখ মাহেদী পুরো ১০ ওভার বল করেছিলেন। এর পরের দুটি ম্যাচে পার্টটাইমার হিসেবে কখনো আফিফ, কখনো শামীমকে এক ওভার করে হাত ঘুরাতে দেখা যায়।

বিপরীতে বিশ্বক্রিকেটে প্রায় প্রতিটি দলকেই এখন একাধিক ষষ্ঠ বোলিং অপশন নিয়ে মাঠে নামতে দেখা যায়। এ ম্যাচে পাকিস্তান যেমন মিডিয়াম পেসার ফাহিম আশরাফকে দিয়ে ৭ ওভার বল করিয়েছে। হার্দিক পান্ডিয়া, দাসুন শানাকাদের প্রায়ই এমন ভূমিকায় দেখা যায়।

সেখানে বাংলাদেশ দলের একটা বড় ঘাটতি দেখছেন সানোয়ার হোসেন। ‘অনেক দিন যাবত এই গ্যাপ। একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার যদি দলে থাকে, সে হার্দিক পান্ডিয়া টাইপ না হোক কাছাকাছি কেউ, কিন্তু ওই জায়গায় আমাদের গ্যাপ আছে।’

তিনি বলেন, ‘একজন লেগ স্পিনারেরও অভাব আছে দলে। সেটা আমরা তৈরি করতে পারিনি, আবার যারা সুযোগ পেয়েছে তারাও সেই কোয়ালিটি শো করতে পারছে না। এখানে পারফরম্যান্সটা গুরুত্বপূর্ণ।’

ধারাবাহিকতা নেই
শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের সাথে ম্যাচে ২০০ রান পার করতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ। ৫০ ওভার ব্যাটও করতে পারেনি তারা। কিন্তু আবার আফগানিস্তানের সাথে দাপট দেখিয়েছে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরাই। দলে ধারাবাহিকতার সমস্যাকেই তাই বড় করে দেখছেন সবাই।

অধিনায়ক সাকিব আল হাসান মনে করেন, বাংলাদেশের পারফরম্যান্সে ধারাবাহিকতার অভাব আছে।

‘আমরা বোলিংয়ে ভালো করছি। কিন্তু আমাদের ব্যাটিং কখনো ভালো তো কখনো খারাপ হচ্ছে। এদিকটায় আমাদের ধারাবাহিক হয়ে ওঠার চেষ্টা করতে হবে,’ বলেন তিনি।

সহকারী কোচ নিক পোথাস মনে করেন সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে আরো পরিণত হতে হবে বাংলাদেশকে।

‘আমাদের বড় সমস্যা হলো ডিসিশন মেকিং। সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ব্যর্থ হয়েছে বাংলাদেশ।’

এশিয়া কাপে গ্রুপ পর্বের পর এবার সুপার ফোরে এসেও ‘ডু অর ডাই’ সিচুয়েশনের সামনে বাংলাদেশ দল। ফাইনালের আশা বাঁচিয়ে রাখতে শনিবার শ্রীলঙ্কার সাথে ম্যাচে জয়ের বিকল্প নেই সাকিব-মুশফিকদের। এরপর ১৫ সেপ্টেম্বর সুপার ফোরে নিজেদের শেষ ম্যাচে ভারতের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ।

সূত্র : বিবিসি