বৃদ্ধাশ্রম নয়, সন্তানের ঘর হোক বাবা-মার আশ্রম

0
207

এম এ মাসুদ, সুন্দরগঞ্জ(গাইবান্ধা) প্রতিনিধিঃ বাবা-মার নেই কোনো জাত, নেই কোনো অঞ্চল, নেই ভৌগোলিক সীমারেখা, নেই কোনো দেশ। পৃথিবীর সব বাবা-মার ধর্ম ও পরিচয় শুধুই বাবা-মা। যাদের স্নেহ ভালবাসায় নেই কোন খাঁদ , নেই কৃত্রিমতা। প্রতিটি বাবা-মা ই তার সন্তানকে সেই জন্মলগ্ন থেকে মায়া,মমতা আর স্নেহের পরশ বুলিয়ে তিল তিল করে বড় করে তোলেন। চান বড় বা উচ্চ শিক্ষিত হয়ে মানুষের মত মানুষ হোক, সমাজের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়াক, হোক সম্মানিত, চিনুক সবাই। সন্তানের সাফল্যের সাথে বাবা-মার সাফল্যও যেন একই সূত্রে গাঁথা। তাদের সাফল্যে নিজেকে সফল ভাবেন, হন খুশি আর পান মানসিক পরিতৃপ্তি।

অর্থনীতিতে জনসংখ্যা বিষয়ে পড়তে গিয়ে জেনেছি, কৃষি ভিত্তিক অর্থনীতিতে শ্রমের যোগান হিসেবে বা বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার প্রতীক হিসেবে পুত্র সন্তান কামনা করতেন বাবা-মা। কিন্তু সময় বদলেছে, মানুষ এখন অনেকটাই সচেতন হয়েছে, এগিয়েছে দেশ, এগিয়েছে বিশ্ব। তাই এখন আর কৃষিতে অতিরিক্ত শ্রমের যোগান বা বৃদ্ধ বয়সে নিরাপত্তার গ্রান্টি হিসেবে পুত্র সন্তানের আশায় একের পর এক সন্তান জন্ম দেন না। প্রত্যেক দম্পতি এখন যৌথভাবে তাদের পরিকল্পনাগুলোকে মনের মাধুরী দিয়ে সুন্দরভাবে সাজান। গড়ে তোলেন পরিকল্পিত পরিবার। আর এরই ধারাবাহিকতায় সন্তানকে নিজেদের মায়া, মমতা, স্নেহ ও ভালবাসা দিয়ে বড় করে তোলেন।

নিজেরা আর্থিক দৈন্যতায় ভুগলেও সেই দৈন্যতা যেন সন্তানকে গ্রাস বা এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে কোন প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে না পারে, সেজন্য চালান বিরতিহীন কর্ম প্রচেষ্টা। বাবা-মার এই যে নিরলস প্রচেষ্টা তা যে শুধু শুধু নিজেদের ভোগ-বিলাস বা সুখের জন্য নয় তা বলাই বাহুল্য। তাদের প্রচেষ্টা শুধুমাত্র সন্তানকে সুখী করার জন্য। যেখানে নেই কোন চাওয়া, নেই কোন পাওয়া, নেই কোন হিংসা, নেই কোন স্বার্থপরতা। সন্তানের পিছনে অকাতরে সব কিছু বিলিয়ে দেয়ার মধ্যেই যেন খুঁজে পান আনন্দ, তাদের সুখের মাঝেই যেন পান প্রকৃত সুখ আর দুঃখে হন দুঃখী। ছায়াদানকারী বৃক্ষরূপে মাথার উপর ছায়া দেয়াই শুধু নয়, সন্তানের নিরাপদ আশ্রয় হিসেবেও যাঁদের জুড়ি নেই, সেই বাবা-মায়ের আশ্রয় যখন হয় কোন বৃদ্ধাশ্রম বা বয়স্ক পুনর্বাসন কেন্দ্রে, তখন তা ওই বাবা-মার জন্য শুধু কষ্টকরই নয়, বেদনাদায়কও বটে। ক্ষত-বিক্ষত হয় তাদের হৃদয়, ভেঙে পড়েন মানসিক দুশ্চিন্তায়।

আবার, সমাজে অনেক পরিবারেই দেখা যায় কয়েকটি সন্তান থাকলেও বাবা-মাকে বা বাবা বেঁচে না থাকলে মাকে একাকী রান্না করে খেতে হয়। থাকার যে ঘরটি তাও আবার সন্তানদের ঘরের তুলনায় অনেকটাই অগোছালো, জীর্ণশীর্ণ। স্ত্রী, সন্তানসহ সবার খাবার জুটলেও কেবল জুটেনা বাবা-মার। আবার তাদের ভালো কাপড় জুটলেও জুটে না বাবা-মার। নিজেরা লেপ, তোষকের মধ্যে থাকলেও বাবা-মার ভাগ্যে জুটেনা তা। সন্তানদের জন্য হরেক রকম খাবার বা ফলমূল জুটলেও বাড়িতে বাসায় যে বৃদ্ধ বাবা-মা আছে যারা এখন অবুঝ শিশুর মতো, তাদের জন্য নেই সেই হরেক রকম খাবার বা ফলমূল। সন্তানের অনুগ্রহের আশায় চেয়ে থাকেন অপলক দৃষ্টিতে। নেই কোনো অভিযোগ।

বিভিন্ন গণমাধ্যমের কল্যাণে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ব্যাংকারসহ অনেক বাবার স্থান হয়েছে বৃদ্ধাশ্রমে, ভাবা যায়! এই তো সে দিন প্রতিদিনের সংবাদের অনলাইন ভার্সনে শিরোনাম হয়েছে ‘ঢাকায় ছেলেদের ফ্লাট থাকা সত্বেও পেটের দায়ে ফুটপাতে বাবা’ প্রিন্ট সংস্করণে শিরোনাম হয়েছে ‘এক বাবার করুণ দশা’।
আবার ‘ সাত ছেলেই প্রতিষ্ঠিত, মোমেনা খাতুনের মানবেতর জীবনযাপন’ শিরোনামে আরেকটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে গত ৪ সেপ্টেম্বর।

ত্রিশ বছর আগে স্বামীর মৃত্যুর পর সংসারের হাল ধরেছিলেন ময়মনসিংহের গফরগাঁও পৌরসভার হাসিনা বেগম। ১০৫ বয়সী ওই বৃদ্ধা বিভিন্ন রোগে ভুগছিলেন। তাকেও ছেলেরা কনকনে শীতে বস্তায় ভরে রাস্তায় ফেলে গিয়েছেন বলে আরেকটি অনলাইন পোর্টাল থেকে জানা যায়।

কয়েকদিন আগে আরো একটি শিরোনাম দেখে চোখ আটকে গিয়েছিল। শিরোনাম ছিল ‘শান্তিতে ঘুমাতে ফেলে গেল ছেলে, প্রচন্ড শীতে কাঁদছিলেন বাবা’ এ শিরোনামগুলো থেকে অনুমান করতে খুব একটা কষ্ট হয় না বাবা-মায়েদের বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ধারণা পেতে। আর আমরা আমাদের চারপাশে তো তা দেখছি।

অথচ এই বৃদ্ধ বাবা-মা ই একদিন তাদের সন্তানের জন্য আরামের ঘুম হারাম করে দিন-রাত করেছেন পরিচর্যা, ভালো খাবার না খেয়ে হাসি মুখে তা তুলে দিয়েছেন সন্তানের মুখে। নিজেরা ভালো বস্ত্র না পরে সামর্থ অনুযায়ী দিয়েছেন সুন্দর সুন্দর পোশাক। বুক ভরা আশা নিয়ে পড়িয়েছেন ভালো ভালো স্কুল, কলেজ, মেডিকেল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে। বানিয়েছেন ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক আরো কত কি! আর নিঃস্বার্থভাবে সর্বদাই করেছেন স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা, চেয়েছেন তাদের মঙ্গল।

যে বাবা-মার বদৌলতে আমরা দেখেছি পৃথিবীর মুখ, দু’চোখ ভরে উপভোগ করছি প্রকৃতির অপরূপ সৌন্দর্য, যাদের আদর, যত্ন, স্নেহ, মমতায় বড় হয়েছি, নিজে চলার মতো সামর্থবান হয়েছি, হয়েছি প্রতিষ্ঠিত। সেই বাবা-মার প্রতি রয়েছে আমাদের অনেক দায়িত্ব ও কর্তব্য। আমাদের ভুলে গেলে চলবেনা যে আমরাও একদিন বাবা-মা হবো, হবো শ্বশুর-শ্বাশুড়ী। বয়সের ভারে হবো বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা। তখন প্রকৃতি যেন প্রতিশোধ না নেয়! মানুষের তিরস্কারের পাত্রও যেন না হই! ধর্মীয় দৃষ্টি কোণ থেকে তো বাধ্যবাধকতা রয়েছেই বাবা-মার সেবা-যত্ন করার, বিনিময়ে পুরষ্কার হিসেবে রয়েছে জান্নাত।

প্রথম মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন মাকে নিয়ে লিখেছেন”আমার দেখা সবচেয়ে সুন্দরী মহিলা আমার মা। মায়ের কাছে আমি চিরঋণী। আমার জীবনের সমস্ত অর্জন তারই কাছ থেকে পাওয়া নৈতিকতা, বুদ্ধিমত্তা আর শারীরিক শিক্ষার ফল।”

১৬ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন বলেছেন”যার মা আছে, সে কখনই গরীব নয়।”

কবি কাজী কাদের নেওয়াজের ‘মা’ কবিতায় পড়েছি-
মা কথাটি ছোট্ট অতি,
কিন্তু জেনো ভাই,
ইহার চেয়ে নামটি মধুর
তিন ভূবনে নাই।
সুতরাং কোন বৃদ্ধাশ্রম নয়, সন্তানের সবচেয়ে সাজানো, গোছানো ও সুন্দর ঘরটিই হোক বাবা-মায়ের আশ্রম।