বিনোদন

মেঘনার গ্রেপ্তারে কূটনৈতিক পাড়ায় তোলপাড়

মিস বাংলাদেশ খ্যাত মেঘনা আলমের গ্রেপ্তার নিয়ে তোলপাড় কূটনৈতিক পাড়া ও সোশ্যাল মিডিয়া। কেন তাকে বিশেষ ক্ষমতা আইনে গ্রেপ্তার করা হলো- এ নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। এর মধ্যেই সুন্দরী মেয়েদের মাধ্যমে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রেমের ফাঁদে ফেলার ঘটনায় প্রতারণার মামলায় মেঘনা আলমের সহযোগী, কাওয়াই প্রতিষ্ঠানের সিইও ও সানজানা ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. দেওয়ান সমিরের (৫৮) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ ফারজানা হক রিমান্ডের এ আদেশ দেন।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা গেছে, ১০ এপ্রিল বসুন্ধরা এলাকায় একটি সংঘবদ্ধ প্রতারকচক্র সুন্দরী মেয়েদের মাধ্যমে বিভিন্ন বিদেশি রাষ্ট্রদূত এবং ধনাঢ্য ব্যক্তিদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রতারণা করে অর্থ আদায়ের চেষ্টা করে। ওইদিন রাত ১০টা ৩৫ মিনিটে আসামি দেওয়ান সমীরকে সেখানে পাওয়া যায়।

এদিকে অনতিবিলম্বে মেঘনা আলমের মুক্তি ও ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিলের দাবি জানিয়েছে একাধিক রাজনৈতিক দল। বলা হয়েছে, বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমের আটকের ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের স্বৈরাচারী আচরণের বহিঃপ্রকাশ। গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটিও বিবৃতি দিয়েছে।

তবে একাধিক কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে, মেঘনা আলম নিজের সেলিব্রিটি পরিচয় ব্যবহার করে ঢাকায় বিদেশি একাধিক রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক গড়ে তোলেন। এরপর কূটনীতিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের আর্থিক সুবিধা নিতেন এবং পরে তাদের দুর্বলতার সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ব্ল্যাকমেইল করতেন। তার এই ব্ল্যাকমেইলের অভিযোগটি বিদায়ী সৌদি রাষ্ট্রদূত ঈসা বিন ইউসুফ বিন ঈসা আল দুহাইলান নিজে প্রধান উপদেষ্টা, পররাষ্ট্র উপদেষ্টা, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টাসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন মহলে আনুষ্ঠানিক ও অনানুষ্ঠানিকভাবে তুলেছেন যখন তিনি বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের হস্তক্ষেপ ও প্রতিকারও চেয়েছেন তিনি।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, সৌদি রাষ্ট্রদূত নিজেই যখন এই ব্ল্যাকমেইলের শিকার এবং তিনি এ ব্যাপারে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে অভিযোগ দিয়েছেন তাই বিষয়টি স্পর্শকাতর বিবেচনায় নিয়ে আমলে নিয়েছে সরকার। এছাড়া একাধিক বিদেশি রাষ্ট্রদূত ও কূটনীতিকের সঙ্গে মেঘনা আলমের সম্পর্ক এবং তাদেরও ব্ল্যাকমেইল করতে পারে বলে মনে করছে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহল। এতে ওইসব দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক অবনতির আশঙ্কা থাকতে পারে। যেহেতু সৌদি রাষ্ট্রদূতের সম্মানহানি করার বিয়য়টি মেঘনা আলম তার ফেসবুক পোস্টে উল্লেখ করেছেন, তাই অভিযোগটি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে সরকার।

সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বিশেষ সখ্যের বিষয়টি মেঘনা আলম প্রথম ৩ মার্চ সোশ্যাল মিডিয়ায় তুলে ধরেন এবং তার সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গোপন রাখার বিনিময়ে আর্থিক সুবিধা আদায়ের চেষ্টা চালিয়ে যান। যেহেতু সৌদি রাষ্ট্রদূত চলে যাচ্ছেন তাই তাকে ব্ল্যাকমেইল করে বড় আর্থিক সুবিধা পেতে জাপানে প্রবাসী ব্যবসায়ী দেওয়ান সমীর ও মনির নামে দুজন সহকর্মীকে অর্থ আদায়ে সম্পৃক্ত করেন। এ জন্য মেসেজে তিনি রাষ্ট্রদূতের বিরুদ্ধে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক পরিসরে মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মানহানির মামলার হুমকিও দেন।

সফল না হওয়ায় গত ২৫ মার্চ সোশ্যাল মিডিয়ায় সৌদি দূতের সঙ্গে কিছু ছবি পোস্ট করে তার অন্তরঙ্গ সম্পর্কের জানান দেন। এদিনই সৌদি রাষ্ট্রদূত তার প্রতারণা ও ব্ল্যাকমেইলের বিষয়টি সরকারের বিভিন্ন উচ্চমহলসহ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে অবহিত করে ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ করেন। কিন্তু সরকার মেঘনা আলমকে গ্রেপ্তার করলেও স্পর্শকাতর ইস্যু হওয়ায় এ নিয়ে কোনো বিবৃতি দেওয়া হয়নি।

সূত্র জানায়, মেঘনা আলম চেয়েছিলেন সৌদি রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সালিশি প্রক্রিয়ায় এর সমাধানের চেষ্টা করা এবং পুরো সালিশি প্রক্রিয়াটির ভিডিও ধারণ করে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া। এ লক্ষ্যে তিনি সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ে এবং কূটনৈতিক পাড়ায়ও দেনদরবার করেন। এ কাজে তিনি আরবভুক্ত একটি দেশের রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে সালিশের ব্যবস্থা গ্রহণের চেষ্টা চালান। কিন্তু বিষয়টি কূটকৌশল ও অবাস্তবিক বিবেচনা করে ওই রাষ্ট্রদূত এ ব্যাপারে আর বেশিদূর এগোননি। এদিকে ঈদের ছুটির পর সৌদি রাষ্ট্রদূত ঢাকায় ফিরলে তাকে ঘিরে মেঘনা আলম তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী সমীরসহ সিন্ডিকেটের অন্যরা সৌদি রাষ্ট্রদূতকে ব্ল্যাকমেইল করে বড় আর্থিক সুবিধা আদায়ের একটি কৌশল ঠিক করেন। এই ঘটনায় দেওয়ান সমীরকেও গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

জানা গেছে, মেঘনা আলম সেলিব্রিটি পরিচয়ে অবাধে কূটনৈতিক পাড়ায় যাতায়াত করতেন। সর্বশেষ বুধবার যখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয় তখনো তার বাসায় ৪ জন তরুণী ছিলেন বলে জানা গেছে।

কূটনীতিক সূত্র জানায়, গত ফেব্রুয়ারিতে থাইল্যান্ড যাওয়ার জন্য এবং গত নভেম্বরে ভারত ভ্রমণের জন্য সৌদি রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে এয়ার টিকিট উপহার নেন। আলোচনা রয়েছে, ঢাকায় বিভিন্ন দেশের জাতীয় দিবসের অনুষ্ঠানে সেলিব্রিটি হিসেবে নিজেকে উপস্থাপন ও রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতেন। এসব অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে পরিচিতি ও সখ্য গড়ে তুলে ছবি তুলতেন। পরে যোগাযোগ করে ওই রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে নানা প্রস্তাব নিয়ে সাক্ষাৎ করতেন। এ সময় বিদেশে সুন্দরী প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের নামে একাধিক তরুণীর ভিসা ও আর্থিক সুবিধা নিতেন। মেঘনা আলম তার সর্বশেষ পোস্টে অনেক স্ববিরোধী বক্তব্য হাজির করেছেন।

সৌদি রাষ্ট্রদূতকে একদিকে তার বিবাহিত বলে দাবি করেছেন, অপরদিকে, বলেছেন যে এ সম্পর্ক তার আইনসিদ্ধ নয়, তার বিয়ের কোনো বৈধ ডকুমেন্ট নেই। তিনি আরও বলেন, তার বিয়ের দিন তার দুই বোন সাক্ষী হিসেবে উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু তার ফেসবুকে শেয়ার করা পোস্টে দেখা যায়, ৪ ডিসেম্বর তিনি সৌদি রাষ্ট্রদূতের বাসায় একটি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন যেখানে ছবিতে বিভিন্ন দেশি কিছু ব্যক্তির সঙ্গে ছবিতে ক্যামেরাবন্দি হয়েছেন। সেখানে ছবিতে তাদের কোনো বোন উপস্থিত নেই।

মডেল মেঘনার সহযোগী পাঁচ দিনের রিমান্ডে

সুন্দরী মেয়েদের মাধ্যমে বিদেশি রাষ্ট্রদূতদের প্রেমের ফাঁদে ফেলার ঘটনায় প্রতারণার মামলায় মেঘনা আলমের সহযোগী, কাওয়াই প্রতিষ্ঠানের সিইও ও সানজানা ম্যানপাওয়ার প্রতিষ্ঠানের মালিক মো. দেওয়ান সমিরের (৫৮) পাঁচ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছে আদালত। গতকাল ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ্ ফারজানা হক রিমান্ডের এ আদেশ দেন। গতকাল শনিবার ঢাকার মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সারাহ্ ফারজানা হক উভয় পক্ষের শুনানি শেষে জামিনের আবেদন নাকচ করে দিয়ে সমীরকে পাঁচ দিনের রিমান্ডে দেন। সমিরের মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ভাটারা থানার উপ-পরিদর্শক মো. আরিফুল ইসলাম ১০ দিনের রিমান্ডের আবেদন করেন।

মেঘনা আলমের মুক্তি ও বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল চায়

১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনে আটক মেঘনা আলমের মুক্তির দাবি জানিয়েছে গণতান্ত্রিক অধিকার কমিটি। একইসঙ্গে এই আইন বিলোপেরও দাবি জানানো হয়েছে। গতকাল শনিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে এই দাবি জানানো হয়। সংগঠনের সদস্য অধ্যাপক আনু মুহাম্মদের পাঠানো বিবৃতিতে বিশেষ ক্ষমতা আইনে মেঘনা আলমের আটকের ঘটনাকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগের স্বৈরাচারী আচরণের বহিঃপ্রকাশ বলে উল্লেখ করা হয়।

বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেছেন, ‘মিস আর্থ মেঘনা আলমকে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ ছাড়া তার বাসার দরজা ভেঙে গ্রেপ্তার এবং ১৯৭৪ এর বিশেষ ক্ষমতা আইনে ৩০ দিনের আটকাদেশের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ ও নিন্দা জানাই। যেভাবে মেঘনাকে বাসা থেকে জবরদস্তিমূলকভাবে তুলে নিয়ে নিবর্তনমূলক কালো আইনে সাজা দিয়ে জেলে পাঠানো হয়েছে কেবল বিগত দিনের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের কথাই মনে করিয়ে দেয়। এই ঘটনা মানবাধিকারের চূড়ান্ত লঙ্ঘন।

এই বিভাগের আরও খবর পড়ুন

Back to top button